আমরা মুসলিমদের গৌরবময় চৌদ্দশো বছরের ইতিহাসের কথা বলি। তবে এই চৌদ্দশো বছরের ইতিহাস পুরোটা ফুলে ফুলে সুবাসিত ছিলো না। মুসলিমদের উত্থান ছিলো, পত্তন ছিলো। মুসলিমরা কখনো হেরেছে, কখনো জিতেছে, তবে সামগ্রিকভাবে একটা মর্যাদার আসন তারা ধরে রেখেছিলো।
কিন্তু বর্তমান সময়ে আমরা মুসলিমদের মধ্যে এমন কিছু দেখছি যেটা সম্ভবত এতটা প্রকট অতীতে কখনই হয়নি — সেটা হলো নিজের মুসলিম পরিচয় নিজে লজ্জাবোধ করা। আমরা মুখে যতোই বলি না কেন — মুসলিমরা শ্রেষ্ঠ জাতি, ইসলামের শত্রু সেকুলার এবং কাফিরদের সামনে ঠিকই আমরা নিজেদের মুসলিম পরিচয় নিয়ে গর্ব করতে পারি না। তারা যখন বলে, তোমার ইসলাম এমন কেন? আমরা তখন মাথা নেড়ে আমতা আমতা করে বলি, না না! ‘ইসলাম তো আসলে এমন না! তোমরা যেমনটা দেখতে চাচ্ছো, ইসলাম আসলে তেমন!’
দ্বীন ইসলামের ব্যাপারে আমাদের আত্মবিশ্বাস তলানিতে ঠেকেছে। তাই, আমরা আজ মুসলিমরাই, যারা সালাত আদায় করি, যারা সিয়াম রাখি, তারা ইসলামের এমন সব ব্যাখ্যা হাজির করছি, যে ব্যাখ্যা আমাদের ফিক্বহ কিংবা ইতিহাসের বিচারে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাই আমরা মুসলিমরাই আজ শরীয়াহকে বলছি মধ্যযুগীয়, জিহাদকে বলছি সন্ত্রাসবাদ। সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, পুঁজিবাদ, নারীবাদ, জাতীয়তাবাদ, ডানপন্থা, বামপন্থা, ধর্মনিরপেক্ষতা — সবকিছুই ইসলামের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ! আচ্ছা, পশ্চিমাদের থেকে ধার করা এই আদর্শ আর মূল্যবোধগুলো সবই যদি ইসলামের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, তাহলে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পাঠানোর কী প্রয়োজন ছিলো? পশ্চিমাদের থেকে ইসলাম শিখে নিলেই হতো!
দ্বীন ইসলামের ব্যাপারে আমাদের মানসিকতা এতটাই ডিফেনসিভ হয়ে গেছে যে, আজ আমরা সামান্য দাড়ি রাখতে, পরিপূর্ণ হিজাব পালন করার আগে দশবার ভাবি, আর বলি মানুষ কী ভাববে? সুদী ব্যাংকে চাকরি করা সুটেড-বুটেড পরিপাটি অফিসারের চোখে চোখ রেখে আমরা বলতে ভয় পাই — তুমি তো আল্লাহ ও তার রাসূলের সাথে যুদ্ধ করছো! উল্টো তারাই চোখ রাঙ্গিয়ে বলে, এই যুগ সুদ ছাড়া চলে কী করে? আমরা মিনমিন করে মুখ লুকাই। আল্লাহ আমাদের শ্রেষ্টত্ব দিয়েছিলেন কারণ আমরা ভালো কাজে আদেশ দিই আর খারাপ কাজে নিষেধ করি। কিন্তু আল্লাহর দেওয়ার এই শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি কী নিদারুণ অবজ্ঞা যখন আমরা দেখি মাথায় স্কার্ফ পেঁচানো মুসলিম নারী সমকামিতা নামের জঘন্য গুনাহ আর ক্রাইমের বৈধতা নিয়ে গলা উঁচিয়ে কথা বলে!
এমন তো কথা ছিলো না! কথা ছিলো আমরা কাফিরদের কাছে ইসলামের আলো নিয়ে যাবো। সেটা আজ হচ্ছে না, উল্টো আমরা লানতপ্রাপ্ত, নীতিবোধহীন জাতিগুলোর অন্ধ অনুকরণ করছি যারা লানতপ্রাপ্ত। অন্ধ অনুকরণের একটা চটকদার নামও আমরা দিয়েছি — “যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলা।” আর যারা এই জাহিলিয়াতকে প্রত্যাখ্যান করে, তাদের সাথেই আমাদের যত তর্জন-গর্জন। ইসলামকে আমাদের প্রকাশ করে দেওয়ার কথা ছিলো, কিন্তু আমরা ইসলামকে লুকোতে লুকোতে একেবারে ঘরের কোণ আর মসজিদে ঠেলে দিয়েছি।
ভাই ও বোনেরা, আকাশ ও পৃথিবীকে যিনি সৃষ্টি করেছেন, যিনি আপনাকে তৈরি করেছেন শ্রেষ্ঠতম গঠনে, যিনি মহাবিশ্বের সবকিছুর মালিক, সেই রব, সেই মালিক, সেই আল্লাহ আমাদেরকে দ্বীন ইসলাম দিয়ে সম্মানিত করেছেন, আর আমি-আপনি সম্মান খুঁজছি আজ কীসের মাঝে? কাদের মাঝে? কাদের মতো হতে চাই আমরা? যাদের আল্লাহ পথ দেখিয়েছেন তাদের? নাকি যারা আল্লাহর দেওয়া দ্বীনকে সেকেলে মনে করে, তুচ্ছ করে, থোরাই কেয়ার করে — তাদের?
আল্লাহর কসম! সম্মান তো কেবল দ্বীন ইসলামকে মেনে চলার মাঝে। আল্লাহ হচ্ছেন সেই সত্তা, যিনি মর্যাদা দেন এবং লাঞ্চিত করেন। আল্লাহর প্রতি যে সত্যিই ঈমান এনেছে, সে কখনও আল্লাহর দ্বীন নিয়ে হীনমন্ম্যতায় ভুগতে পারে না। সে পুরো পৃথিবীর সামনে মাথা উঁচু করে চলতে জানে, সে কখনো তার পরিচয় নিয়ে লজ্জিত বোধ করেনা।
আমাদের এবারের পর্ব এমন কিছু নিয়ে, যা আমরা প্রায় হারাতে বসেছি — ইযযাহ!