আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কুরআনে সূরা বাকারায় বলেন,
“অতঃপর তোমরাই পরস্পর খুনাখুনি করছ এবং তোমাদেরই একদলকে তাদের দেশ থেকে বহিস্কার করছ। তাদের বিরুদ্ধে পাপ ও অন্যায়ের মাধ্যমে আক্রমণ করছ। আর যদি তারাই কারও বন্দী হয়ে তোমাদের কাছে আসে, তবে বিনিময় নিয়ে তাদের মুক্ত করছ। অথচ তাদের বহিস্কার করাও তোমাদের জন্য অবৈধ। তবে কি তোমরা গ্রন্থের কিয়দংশ বিশ্বাস কর এবং কিয়দংশ অবিশ্বাস কর? যারা এরূপ করে পার্থিব জীবনে দূগর্তি ছাড়া তাদের আর কোনই পথ নেই। কিয়ামতের দিন তাদের কঠোরতম শাস্তির দিকে পৌঁছে দেয়া হবে। আল্লাহ তোমাদের কাজ-কর্ম সম্পর্কে বে-খবর নন।” [ ২:৮৫]
এই আয়াতে বনী ইসরাইলের একটি ঐতিহাসিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে। তারা কখনই তাদের গোত্রের বা সমাজের মানুষকে ভুলে যায় না।
ইউশা ইবনে নুন (আলাইহিস সালাম) এর মৃত্যুর পরে বনী ইসরাইলের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। তাদের এক গোত্র অন্য গোত্রকে আক্রমণ করতে থাকে এবং নিজ ভূমি থেকে তাড়িয়ে বহিঃশত্রুর হাতে নিজেদের ভাইদের তুলে দিতে থাকে। এরপরও তাদের মধ্যে একটি গুণ তখনও বিদ্যমান ছিল। আর তা হল তাদের গোত্রের কেউ বন্দী হলে তারা তাকে উদ্ধার করতে ব্যস্ত হয়ে যেত। যদিওবা তারা নিজেরাই প্রাথমিকভাবে এসব শুরুর পেছনে দায়ী! আজকেও আপনারা তাদের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য দেখতে পাবেন। যখনই কোনো ইসরাইলী সৈন্যকে বন্দী করা হয় তখনই তারা তাকে উদ্ধারে সচেষ্ট হয়ে পড়ে। ২০০৬ সালে গোটা ইসরাইলী বাহিনীর লেবানন আক্রমণের পেছনে অজুহাত ছিল গুটিকয়েক ইসরাইলী সৈন্যকে মুক্ত করা। এমনকি ইসরাইলীরা যখন হামাসের সাথে প্রায়ই বন্দী বিনিময় করে তখন বন্দী বিনিময়ের অনুপাতটি বেশ চমকপ্রদ। যেমন দশ হাজার প্যালেস্টাইনীর বিনিময়ে মাত্র তিন জন ইসরাইলী সৈন্য! এই ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্যটি বনী ইসরাইল আজও ধরে রেখেছে। শত্রুর হাতে পতন আসন্ন হয়ে পড়লেও তারা যেকোনো মূল্যে তাদের বন্দী ভাইকে মুক্ত করার চেষ্টা করে।
প্রথম যুগের মুসলিমরা তাঁদের বন্দী মুসলিম ভাইদের উদ্ধারের ব্যাপারে ঠিক এমনই যত্নশীল ছিলেন। ‘উমার ইবন ‘আবদুল আজিজ (রা) মুক্তিপণের অঙ্কের ব্যাপারে পরোয়া না করেই মুসলিম বন্দীদের ছাড়িয়ে আনার জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন। আল ইমাম আল আওযা’ই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে চিঠি লিখে আবু জা’ফর আল মানসুরকে নিয়মিত স্মরণ করিয়ে দিতেন যেন রোমানদের হাত থেকে মুসলিম বন্দীদের যেভাবেই হোক উদ্ধার করা হয়। মুসলিম বন্দীদের উদ্ধারের ব্যাপারে ইবনে তাইমিয়াহ (রহিমাহুল্লাহ) ছিলেন নিবেদিত এক অক্লান্ত প্রাণ। চিঠি লিখে, সমঝোতা করে, যুদ্ধ করে হলেও তিনি মুসলিম বন্দীদের মুক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যেতেন। আল হাজ্জাজ ও আল মু’তাসিমের মত অত্যাচারী মুসলিম শাসকরাও কুফফারদের কারাগারে বন্দী এক-দুইজন মুসলিমকে উদ্ধার করতে সমগ্র শহরে আক্রমণ করতে দ্বিধাবোধ করেননি। আল মানসুর বিন আবু ‘আমির ঘোড়ার পিঠে চড়ে কর্ডোভা থেকে উত্তর আন্দালুসিয়ায় গিয়েছিলেন! শুধুমাত্র এক মুসলিম বন্দীর মায়ের অনুরোধে খ্রিষ্টানদের হাতে আটক তার ছেলেকে উদ্ধারের জন্য।
এটাই আমাদের ইতিহাস। এটাই আমাদের ঐতিহ্য; যা বিশ্বস্ততা, সাহসিকতা আর নিঃস্বার্থতার কাহিনীতে পূর্ণ। সেটা ছিল এমন একটা সময় যখন মানুষ নিজের আরাম আয়েশের উপরে অন্যের স্বস্তি আর নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দিত। তাঁদের জীবন থেকে শিক্ষা নিন। বনী ইসরাইলের উদাহরণের উপরও দৃষ্টিপাত করুন। হৃদয় থেকে কাপুরুষতা ঝেড়ে ফেলুন। স্বার্থপর ধ্যানধারণা ভুলে গিয়ে উম্মাহ্র প্রতি আরো অনুগত, বিশ্বস্ত ও দায়িত্বশীল হোন। নিজের কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হওয়ার এটাই সময়। কিভাবে একজন মানুষ নিজেকে মুসলিম সমাজের ‘‘সক্রিয় কর্মী’’ বলে দাবি করতে পারে যখন তাদের ভাইরা (শুধু ভাই নয়, এখন আমাদের বোনেরাও) কানাডা, আমেরিকা, গুয়ান্তানামো বে, ব্রিটেন, ভারত ইত্যাদি দেশের কারাগারে বন্দী রয়েছে? অথচ সে তাদের উদ্ধারের ব্যাপারে কোনো ভূমিকাই পালন করছে না! আর কতজন বন্দী হলে আপনি এগিয়ে আসবেন? পশ্চিমা ‘আলেম’’রা পরিষ্কারভাবেই এই ব্যাপারে নিজেদের অনাগ্রহ বুঝিয়ে দিয়েছেন। কাজেই তাদের আশা ছেড়ে দিন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছিলেন একাধারে রাষ্ট্রপ্রধান, সামরিক প্রধান, স্বামী, পিতা, শিক্ষক এবং আল্লাহর রাসূল। এই শত ব্যস্ততাও তাঁকে অত্যাচারিত মুসলিমদের নাম মনে রাখতে ও তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়ানো থেকে ভুলিয়ে রাখতে পারেনি। আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত যে, রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর দু’আতে মু’মিনদের নামগুলো ধরে ধরে উচ্চারণ করে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতেন। তিনি বলতেন, “ও আল্লাহ্! আল ওয়ালিদ বিন আল ওয়ালিদ, সালামাহ বিন হিশাম এবং আইয়াশ বিন আবু রাবিয়াহ সহ সকল অত্যাচারিত মু’মিনদের তুমি উদ্ধার করো।” প্রকাশ্যে ও জনসম্মুখে তিনি মজলুমদের জন্য দু’আ করতেন।
নিজের সমাজের মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসা ফিতরাতের একটি সহজাত বৈশিষ্ট্য। এটাকেই বনী ইসরাইলীরা নিজেদের মাঝে ধরে রেখেছিল। কিন্তু এটা মুসলিমদের জন্য সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক যে এই ক্ষেত্রটিতে আমরা তাদের অনেক পেছনে পড়ে আছি। এটি লজ্জার বিষয় যে আমরা আমাদের ধর্মীয় ঐতিহ্য রক্ষায় লজ্জাজনক ভাবে ইহুদিদের কাছে পরাস্ত হচ্ছি।
তারিক মেহান্না,
প্লাইমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি,
আইসলেশন ইউনিট, সেল #১০৮।
“অতঃপর তোমরাই পরস্পর খুনাখুনি করছ এবং তোমাদেরই একদলকে তাদের দেশ থেকে বহিস্কার করছ। তাদের বিরুদ্ধে পাপ ও অন্যায়ের মাধ্যমে আক্রমণ করছ। আর যদি তারাই কারও বন্দী হয়ে তোমাদের কাছে আসে, তবে বিনিময় নিয়ে তাদের মুক্ত করছ। অথচ তাদের বহিস্কার করাও তোমাদের জন্য অবৈধ। তবে কি তোমরা গ্রন্থের কিয়দংশ বিশ্বাস কর এবং কিয়দংশ অবিশ্বাস কর? যারা এরূপ করে পার্থিব জীবনে দূগর্তি ছাড়া তাদের আর কোনই পথ নেই। কিয়ামতের দিন তাদের কঠোরতম শাস্তির দিকে পৌঁছে দেয়া হবে। আল্লাহ তোমাদের কাজ-কর্ম সম্পর্কে বে-খবর নন।” [ ২:৮৫]
প্লাইমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি,
আইসলেশন ইউনিট, সেল #১০৮।
Leave A Comment